চলমান পরিস্থিতিতে চরম দুর্দশায় রয়েছে বাংলাদেশের মানুষও, যেখানে এই মহামারিটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রতিনিয়তই উদ্বেগ বাড়ছে।
রাজধানী ঢাকার গৃহহীন ও বস্তিবাসী যাদেরকে শহুরে দরিদ্র বলে মনে করা হয়, তারাই করোনার ঝুঁকিতে থাকা দলগুলোর মধ্যে অন্যতম।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের নবম বৃহত্তম এবং ষষ্ঠ ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসাবে খ্যাত ঢাকায় বসবাস করে ২ কোটিরও বেশি মানুষ। ঢাকার ৩ হাজার ৩৯৪টি জনাকীর্ণ বস্তিতে বাস করা মানুষের মাঝে নতুন এ সংক্রামক ভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই।
দরিদ্র এসব মানুষের বেশিরভাগই বছরের পর বছর ধরে শহরের বাস ও রেলস্টেশনের আশপাশে বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করে আসছে, যাদের মধ্যে অনেকেই দিনমজুর, রিকশাচালক, চায়ের দোকানদার, সিএনজি অটোরিকশা চালক, গৃহকর্মী বা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার সাথে জাড়িত।
সুরাইয়া লাবণী নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘আমি সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। মোহাম্মদপুরে আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে আমার অফিসের দূরত্ব খুব বেশি নয়।। ফেরার সময় রাস্তায় একজন রিকশাচালক আমি কোথাও যেতে চাই কিনা জিজ্ঞাসা করার পর আমি না করে দেই। এরপরই ওই রিকশাচালক কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন তাকে কমপক্ষে ১ হাজার টাকা উপার্জন করতে হয়। কিন্তু আজ সারাদিন পরিশ্রমের পরও তিনি মাত্র ৩৫০ টাকা আয় করতে পেরেছেন, কারণ এখন খুব বেশি মানুষ বাইরে বের হচ্ছেন না।’
যদিও বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং বাংলাদেশের চিত্রও সেক্ষেত্রে আলাদা নয়, তবুও শহরের এই বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই কোভিড-১৯ এর ভয়কে পাশ কাটিয়ে আয়-উপার্জনের জন্য যেভাবে হোক বাইরে বের হওয়ার কথা ভাবছেন।
রশিদ নামে লোকাল বাসের একজন কন্ডাক্টার নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘যখন থেকে দেশে ভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে, তখন থেকে সয়ংক্রিয়ভাবেই আমাদের আয় কমতে শুরু করেছে। বেশিরভাগ মানুষই এখন বাড়িতে থাকছে, কিন্তু ‘কোয়ারেন্টাইন’ মেনে চলার মতো বিলাসিতার সুযোগ আমার নেই, কারণ প্রতিদিন আমার পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য খাবার জোগাড় করতে হয়।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টরা বারবারই সতর্ক করছেন যে, লাখ লাখ বস্তিবাসী এবং শহরের ‘ভাসমান’ মানুষের মাধ্যমে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস বিস্তার রোধের অংশ হিসেবে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই দরিদ্র এসব মানুষের স্বাস্থ্যবিধি এবং খাদ্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা খাবার জোগাড় করার বিষয়ে দুশ্চিন্তা না করে ঘরেই অবস্থান করতে পারে।
এছাড়া, করোনা আতঙ্কে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত কমবেশি সবারই বিভিন্ন কিনে পণ্য মজুদ করে রাখার সক্ষমতা থাকায়, এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে নিম্নবিত্তদের ওপর।
গৃহকর্মী নাজমা বেগম ইউএনবিকে বলেন, ‘এক সপ্তাহের মধ্যে মোটাচালের দাম ৩৬-৩৮ টাকা থেকে দাঁড়িয়েছে ৪৬-৪৮ টাকা। কাজের জন্য যদি আমরা বাইরে না যেতে পারি, তাহলে না খেয়ে মারা যাব।’
দুর্দশাগ্রস্ত এসব মানুষের বিশাল সংখ্যকের বসবাস মিরপুর, কড়াইল, কাফরুল, আদাবর, বাড্ডা, কামরাঙ্গীচর, হাজারীবাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, পল্লবী, ভাষাণটেক, দারুসসালাম, ডেমরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বস্তিতে, যেখানে নেই পয়নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা। এমনকি এসব বস্তিতে নিয়মিত সরবরাহ হয় না পানি, গ্যাস বা বিদ্যুতের মতো জরুরি পরিষেবাও।
নিয়মিত অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ফলে এসব মানুষের মাধ্যমে সহজেই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে, কারণ পুরো শহর জুড়েই এসব মানুষের বিচরণ।
কীভাবে হাত ধুতে হবে, কখন মুখোশ পরা উচিত বা করোনার বিস্তার রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্যান্য নির্দেশনা দূরের বিষয়, করোনার সংক্রমণ রোধে ঘর থেকে বের না হওয়া বা সামাজিক দূরত্বের অনুশীলনের মতো বিষয়েও তেমন কোনো ধারণা নেই বস্তিবাসী বা ভাসমান মানুষদের।
বস্তিবাসীর পাশাপাশি ভাসমান জনগোষ্ঠীর অনেককেই আবার প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষা করতে দেখা যায়, যাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে কোনোই ধারণা নেই।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে বাস করা গৃহহীন রমিজ চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো খেতেই পারি না, আর আপনি স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কথা বলছেন!’
করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ধীরে ধীরে দেশে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও, ঢাকার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
সামাজিক কিছু সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে সাময়িকভাবে দরিদ্রদের মাঝে সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্কসহ বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করলেও, মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ আরও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো অন্যতম সামজিক সংগঠন বিদ্যানন্দ তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে ৭০ হাজার মানুষের জন্য খাবার নিশ্চিত করেছে এবং আরও ২ লাখ মানুষকে সাহায্য করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
কিন্তু এসব উদ্যোগের পরও, আরও অন্তত ১০ লাখ মানুষের জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।
বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে যদি করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়া শুরু করে, তাহলে ঢাকা শহরের বাকীদেরকেও প্রাণঘাতি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
আর এ ভাইরাস যদি বস্তিবাসী বা ভাসমান মানুষের মাঝে ছড়ানো শুরু করে তাহলে এর সংক্রমণ রোধ একরকম অসম্ভব হয়ে উঠবে।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৩ জনে।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানার ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, নভেল করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের ৫ লাখ ৩১ হাজার ৮০৬ জন। এদের মধ্যে বর্তমানে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯১ জন চিকিৎসাধীন এবং ১৯ হাজার ৩৫৭ জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন।
এছাড়া করোনাভাইরাস আক্রান্ত ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৫ জনের মধ্যে ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৪২ জন (৮৪ শতাংশ) সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং ২৪ হাজার ৭৩ জন (১৬ শতাংশ) রোগী মারা গেছেন।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৯৯টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস।